ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪
আপডেট : ১১ মার্চ, ২০২৩ ১৭:৫৫

জমে উঠেছে ৫১৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার মেলা

জয়পুরহাট প্রতিনিধি
জমে উঠেছে ৫১৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার মেলা


জয়পুরহাটে জমে উঠেছে প্রায় ৫১৫ বছর পুরনো ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার মেলা। আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নে প্রতিবছর দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে এ মেলা বসে। দোলপূর্ণিমার দিন থেকে মেলাটি শুরু হয়ে চলে মাসব্যাপী। তবে প্রশাসন এবার অনুমোদন দিয়েছে ১৩ দিনের জন্য। এবার মেলায় যাত্রা ও সার্কাসের অনুমোদন দেয়নি প্রশাসন। এদিকে মেলায় যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকের সদস্য। আর এই মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের গ্রামে গ্রামে চলছে উৎসবের আমেজ।
জানা গেছে, প্রায় ৫শ বছর আগে তৎকালীন সময়ে নন্দিনী প্রিয়া নামক এক সাধক বরেন্দ্র এলাকায় বর্তমানে উপজেলার গোপীনাথপুর থেকে ১ কিলোমিটার উত্তরে গভীর জঙ্গলে নদীর ধারে একটি মন্দির স্থাপন করে পূজা আর্চনা শুরু করেন। তৎকালীন বাংলার শাসক নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এই এলাকার গোপীনাথপুরে বেড়াতে আসেন। গহীন বনের ভিতরে ওই সাধকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তার আতিথিয়তা গ্রহণ করেন। এখানে তার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব ওই সাধককে তাম্রফলকে লিখে পূর্ণ গোপীনাথপুর ও গোপালপুর মৌজার সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে দান করে দিয়ে যান, যার উৎস থেকে প্রতি বছর দোলযাত্রা উপলক্ষে এ মেলা উৎসব চলে আসছে এখানে।
এই মেলার মূল আকর্ষণ ঘোড়া। পুরানো এই মেলা শুরু থেকেই ঘোড়ার জন্যই প্রসিদ্ধ ছিল। আগে মেলায় ভুটান, নেপাল, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আসতো। বর্তমানে টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, খুলনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, পঞ্চগড়, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঘোড়া ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা আসেন এখানে ঘোড়া কেনা-বেচা করতে।
এবার এ মেলায় মুলতানি, মহারাজা, বাদশা, তাজি, রানি, সুইটি, বাহাদুরসহ হরেক রকম নামের ঘোড়া এসেছে। একেকটি ঘোড়ার দাম হাকা হচ্ছে ১ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। ক্রেতারা দেখেশুনে পছন্দ মত কিনছেন ঘোড়া। এই মেলা দেশের একমাত্র ঘোড়ার মেলা বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
এছাড়া দোল শুরুর আগে থেকেই মেলায় বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট আসতে শুরু করে। ঘোড়া ছাড়াও গরু, মহিষ, কাপড়, জুতা, ছাতা, গৃহস্থালি সামগ্রী, মসলা, কাঠের ও প্লাস্টিকের আসবাব পত্র, কম্বল, মিষ্টান্নসহ নানা রকমের দোকানপাট বসেছে। মেলায় দুই থেকে ১০ কেজি ওজনের মিষ্টান্ন’র আকর্ষণ ধরে রেখেছে দীর্ঘ দিন থেকে। এসব দোকান রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় আসে। বগুড়া থেকে আসা ঘোড়া বিক্রেতা দুলাল হোসেন বলেন, প্রতি বছর এই মেলার জন্য আগ্রহে থাকি। এবার তিনটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। প্রতি বছরই কম বেশি লাভ হয়। তবে এবার এখনো ঘোড়া বিক্রি হয়নি।

গাইবান্ধার ঘোড়া বিক্রেতা আনোয়ার বলেন, আমি গত বারেও এই মেলায় ঘোড়া নিয়ে এসেছিলাম। গতবার খুব ভাল লাভ হয়েছিল। এবার মেলায় ছোট বড় মোট ৯টি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। আশা করছি এবারও ভাল লাভ হবে।

টাঙ্গাইল থেকে আসা ঘোড়া বিক্রেতা রুবেল হোসেন জানান, আমরা প্রতি বছর এই মেলাতে ঘোড়া বিক্রি করার জন্য আসি। এই হাটে প্রচুর ঘোড়া বেচাকেনা হয়। এবার আমি ৩টি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে একটি ঘোড়া ২ লাখ টাকা দাম চেয়েছি, বিক্রি করেছি ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।

এদিকে প্রতিদিন বিকেলে একটি খোলা মাঠে চলে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে ঘোড়ার দৌড় দেখার জন্য। তবে এই প্রতিযোগিতা কোন পুরস্কারের জন্য নয়, ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা পরীক্ষার জন্য এই ঘোড় দৌড়ের আয়োজন করা হয়। অনেক ক্রেতারা এখানে ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা দেখে ঘোড়া কিনেন। ঘোড়ার দৌড় দেখতে আসা মতিয়র, রানা, আবু বক্করসহ আরও অনেকে জানান, এই মেলা আমাদের বাপ-দাদার আমলের চেয়েও আগের মেলা। ঘোড়ার দৌড় সচরাচর এখন আর চোখে পড়েনা। তাই এই মেলাতে আমরা পরিবার নিয়ে প্রতিবছর ঘোড়ার দৌড় দেখতে আসি।
গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, গোপীনাথপুর মেলাটি এবার পাঁচ শত ১৫ বছরে পদার্পণ করেছে। এটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম মেলা। এবার প্রশাসন ১৩ দিনের অনুমতি দিয়েছে। মেলায় কোন ধরনের অপ্রিতীকর ঘটনা যেন না ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় রেখে আমরা কাজ করছি।

এ ব্যাপারে আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আক্তার বলেন, এই মেলাকে ঘিরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য বিনোদনমূলক যাত্রা, সার্কাসের অনুমোদন দেয়া হয়নি। কেউ কোন বিশৃঙ্খলা ঘটানোর চেষ্টা করলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেলাটি আমরা নজরদারির মধ্যে রেখেছি।

উপরে