ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৩
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৭:২৩

ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ঢাকার বাসযোগ্যতায় ছাড় দিয়েই ড্যাপ সংশোধন

নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ঢাকার বাসযোগ্যতায় ছাড় দিয়েই ড্যাপ সংশোধন

 

প্রভাবশালী হাউজিং ও ডেভেলপারদের দাবির মুখে রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ ২০১৬-৩৫) সংশোধন করেছে সরকার। এতে আগামী তিন বছরের জন্য ছাড় দেয়া হয়েছে আবাসন প্রকল্পে ভবন নির্মাণের জন্য উচ্চতার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর)। রাজউকের এমন সিদ্ধান্তকে বাজে উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ঢাকার বাসযোগ্যতায় এমন ছাড় বা সংশোধনের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন ড্যাপ অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়বে। সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তারিক হাসানের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে ড্যাপ সংশোধনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া প্রজ্ঞাপন হওয়ার আগে জমির মালিক ও ডেভেলপারদের মধ্যে রেজিস্টার্ড চুক্তি হয়ে থাকলে আগের ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী ভবনের পরিকল্পনা অনুমোদনের সুযোগ দেয়া হয়েছে।

তথ্যমতে, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা, অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ও ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন এমন তিনটি ক্যাটাগরিতে ছাড় দিয়ে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সংশোধিত ড্যাপ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক।

ঢাকার ভবন মালিকরা বলছেন, বৈশ্বিক মানের চেয়ে বেশি ফ্লোর এরিয়া রেশিও দিয়ে পরিকল্পনা দিয়েছে রাজউক। প্রকৃতপক্ষে ঢাকাবাসীর মানসিক, শারীরিক বিকাশ, যানজট আর জলজটের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়নি রাজউক। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নয়-ছয় দেখছেন তারা।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নতুন ড্যাপ প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় এ সংশোধনীর মাধ্যমে তা অকার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রভাবশালীদের চাপের মুখে ধীরে ধীরে পুরো ড্যাপই কাগুজে দলিলে পরিণত হবে বলেও মন্তব্য তাদের।

তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলন, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা বাসযোগ্যতায় ছাড় নয়, বরং জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্যই ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে।

সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের জন্য এটা একটা ব্রিদিং টাইম বা স্বস্তির নিঃশ্বাস বলতে পারেন। নির্দিষ্ট সময় পর আবার আমরা নতুন ড্যাপে ফিরে যাব। সংশোধনীতে যে কেবল এফএআর বাড়ানো হয়েছে তা নয়, সেখানে অন্যান্য বিষয়ও বলা হয়েছে। পুরান ঢাকার জনবহুল এলাকার উন্নয়নে একটা সুন্দর প্রস্তাব রয়েছে। পরিকল্পিত এলাকায় তিন বছরের মধ্যে ভবন করলে কিছু বোনাস এফএআর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে ড্যাপে প্রস্তাবিত রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য জমির সীমানা বরাবর যে পরিমাণ জমি ছেড়ে দেয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, সেটি স্থানীয় সরকারের মালিকানায় দিয়ে দিতে হবে। এতে রাস্তা প্রশস্ত এবং নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হবে। পার্ক, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনভূমি, পুকুর, লেক, জলাশয়, খেলার মাঠসহ অন্যান্য যে নাগরিক সুবিধার শর্তারোপ নতুন ড্যাপে করা হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই পরিবর্তন করা হয়নি। এগুলো নিশ্চিত করতে রাজউক নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছে।’

প্রজ্ঞাপনে মতে, সংশোধিত ড্যাপের কয়েক ক্যাটাগরিতে ভবনের উচ্চতায় ছাড় দেয়া হয়েছে। আগামী তিন বছরের জন্য সরকারি ও রাজউক অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বর্তমান এফএআরের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও দশমিক ৫ এফএআর প্রণোদনা প্রযোজ্য হবে।

এছাড়া যেসব এলাকায় এফএআরের মান ১ দশমিক ৫-এর নিচে সেসব এলাকায় ন্যূনতম ১ দশমিক ৫ এফএআর বিবেচনা করতে হবে। প্লটসংলগ্ন বিদ্যমান রাস্তা ৪ দশমিক ৮ মিটার হলে নতুন ড্যাবে এফএআরের মান দুই। এ বিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এলাকা যেমন- বাড্ডা, ডেমরা, খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, রায়েরবাজার, সাভার, কেরানীগঞ্জসহ এসব এলাকার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সামনে ৩ দশমিক ৬৬ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকলে সেখানে এফএআর বাড়িয়ে দুইয়ে উন্নীত করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন ড্যাপ গেজেটের আগে জমির মালিক ও ডেভেলপারদের মধ্যে রেজিস্টার্ড চুক্তি হয়ে থাকলে আগের ড্যাপ ও ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী এফএআর প্রযোজ্য হবে। ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দশমিক ২৫ এফএআর বাড়ানো হয়েছে সংশোধিত ড্যাপে। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত স্থান, পার্ক ও খেলার মাঠ সংরক্ষণেরও শর্ত রয়েছে। তাছাড়া ড্যাপে প্রস্তাবিত রাস্তা প্রশস্তকরণে জমির সীমানা বরাবর যে পরিমাণ জায়গা ছাড়ার শর্ত দেয়া হয়েছে তা যথাযথ রেজিস্টার্ড ইজমেন্ট দলিল করে নিঃশর্তভাবে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এর পরই কেবল নির্মাণ অনুমোদনপত্র দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি।

প্রভাবশালী হাউজিং ও ডেভেলপারদের চাপেই ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে বলে মনে করছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘‌মাত্র এক বছরের মাথায় ড্যাপ সংশোধনের ফলে ধীরে ধীরে সেটি অকার্যকর হওয়ার দরজা খুলে গেছে। প্রথমত, অন্তত তিন বছরের জন্য সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার বিষয়টি আসছে। দ্বিতীয়ত, আগামী তিন বছরের জন্য সরকারি আবাসন, বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে ভবন নির্মাণে আগ্রহীদের নাগরিক সুবিধা নির্ধারিত স্থান সংরক্ষণের কারণে প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত দশমিক ৫ এফএআর দেয়া হয়েছে। অথচ সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পিত আবাসিক প্রকল্পের জন্য এরইমধ্যে বৈশ্বিক মানের চেয়ে বেশি এফএআর দেয়া আছে ড্যাপে। আমরা বলছিলাম, এফএআর আরো কমানোর জন্য। এখন বলা হচ্ছে সেখানেও বাড়ানো হবে।’

প্রসঙ্গত, নতুন ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর এফএআরের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছিল আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ)। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের সভাপতিত্বে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আবাসন খাতের নেতারা তাদের দাবি তুলে ধরেন। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে গত ১৮ মে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়ার সভাপতিত্বে ড্যাপ বাস্তবায়নসংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড্যাপে ১১টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। এর আলোকেই এ সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে।

উপরে