logo
আপডেট : ৩০ জুন, ২০২০ ১৭:০২
‘ন্যূনতম সম্মান পায়না বলেই চলচ্চিত্রে শিক্ষিত মেয়েদের অনীহা’

‘ন্যূনতম সম্মান পায়না বলেই চলচ্চিত্রে শিক্ষিত মেয়েদের অনীহা’


প্রায় অনেকদিন ধরেই শোবিজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মডেল ও অভিনেত্রী লিউনা লুভাইনা। ২০১২ সালে ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে সেরা বিশে অবস্থান করেন তিনি। এরপর বেশ কিছু ফ্যাশন হাউজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। মডেল ও অভিনেত্রীর বাইরেও তিনি একজন দন্ত্য চিকিৎসক। পড়াশোনার ব্যস্ততার কারণে মাঝে কাজ থেকে বিরতি নেন। প্রায় ৫ বছর বিরতির পর ২০১৭ সালে আবারও কাজে নিয়মিত হন।
বিরতি থেকে ফিরেই কাজ করেন নাটক ও বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপন দিয়ে পরিচিত পান। এখনও নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। ছোট পর্দার বাইরেও তাকে দেখা গিয়েছে চলচ্চিত্রে। গেল বছরের সর্বাধিক আলোচিত ‘পাসওয়ার্ড’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সেখানে তাকে দেখা গিয়েছে সাব- ইনস্পেক্টর চরিত্রে। শাকিব খান প্রযোজিত ও মালেক আফসারি পরিচালিত এই সিনেমা দিয়েই প্রথমবার চলচ্চিত্রে নাম লেখান তিনি। চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে ভালো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি মুখোমুখি হয়েছেন কিছু খারাপ অভিজ্ঞতারও।
প্রথম সিনেমায় কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিউনা জানান, অনেকেরই স্বপ্ন থাকে একটা সময় চলচ্চিত্রে অভিনয় করার। ছোট পর্দায় কাজ করতে করতে একটা সময় সে সুযোগও আসে। চলচ্চিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা যদি বলি তাহলে বলবো, ভালো ও মন্দ দুটোই। আমি অনেক বেশি কাজ করি না। কারণ আমার চেম্বারে বসা, বিভিন্ন মেডিক্যাল ক্যাম্পে জয়েন করা সবকিছু মিলিয়ে যতটুকু সময় পাই সে সময়টা শোবিজে কাজ করার চেষ্টা করি। আমি কখনওই অনেক বেশি কিছু চাইতাম না। যার কারণে হাইলাইটেড হওয়া বা এরকম কিছু নিয়ে ভাবিনি।
সিনেমাতে কাজ করাটা সত্যি আনন্দের ছিল। ছবিটিতে কাজের জন্য আমাকে ফোন দিয়েছিলেন ইকবাল ভাই। তিনি আমাকে জানান যে শাকিব খানের একটি সিনেমায় কাজ করার কথা। তখন আমি গল্প ও চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাই। প্রথমে আমাকে বলা হয়, শাকিব খান ও ইমন যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেই বাসার মালিকের মেয়ের চরিত্রটাতে অভিনয় করার জন্য। তারপর পরিচালক মালেক আফসারির সঙ্গে দেখা করি। উনার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি বলেন যে, এই চরিত্রটা আমার জন্য না, ওটার সাথে আমাকে যায় না। পরে আমাকে অমিত হাসান ভাইয়ের সাথে সহকারী পুলিশের চরিত্রটা করার কথা বলেন। আমি রাজি হই। সিনেমাটির জন্য আমার কাছ থেকে ২১ দিনের শিডিউল চেয়ে নেওয়া হয়। আমিও সম্মতি জানিয়ে চুক্তিবদ্ধ হই। সাইনিংয়ের সময় আমাকে সাইনিং মানি হিসেবে কিছু টাকা দেওয়া হয়।
এই কাজটি করতে গিয়ে আমি যেটা দেখলাম, প্রায় সময়ই আমাকে সকাল সকাল কল টাইম দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হতো। এভাবে অনেকদিন চলতে থাকে। আর সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়েছি যেটা সেটা হলো, সেটের মানুষদের ব্যবহার নিয়ে। প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে, মেকাপ ম্যানসহ সবাইকে দেখতাম কেমন করে যেন কথা বলে। আমি যে একটা মানুষ তারা যেন এটা মনেই করে না। বলতে গেলে একদম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ব্যবহার। আমি হয়তো একজন ছোট শিল্পী হতে পারি তাই বলে কেউ কারো সাথে এমন ব্যবহার করতে পারে না। এটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিলো না। এমনও অনেক দিন হয়েছে যে আমাকে শুটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু কোন শুট করা হয়নি। বসায়ে রেখে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রায় দিনই বসায়ে রেখে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
‘পাসওয়ার্ড’ সিনেমার শুটিংয়ে লিউনা
তারপর ২১ দিনের শিডিউল নিলেও সে অনুযায়ী কোন কাজ করানো হয়নি আমাকে দিয়ে। প্রথম দিকে অমিত হাসান ভাইয়ের সাথে আমার একটা গান করার কথা ছিল। যেহেতু সময়ের স্বল্পতা ছিল তাদের, সবকিছু মিলিয়ে সেটা আর হয়ে উঠে নি। এছাড়াও আমার অনেক অনেক অংশই কেটে ফেলা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে যে, এগুলো বাড়তি, এগুলা লাগবে না।
আমি আমার সব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে এই ২১ দিনের সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ করার পর দিনশেষে কিছুই পেলাম না। এমনকি আমার পেমেন্টও দেওয়া হয়নি। আমি অনেকবার সহ-প্রযোজককে ফোন বা ম্যাসেজ দিলেও তিনি সাড়া দিতেন না। ব্লক করে রাখেন। আমি কয়েকবার অফিসে গিয়েও টা বন্ধ দেখতে পাই, ফিরে আসি। তবুও কিছু বলি নি।
আমার কাছে মনে হয়, সিনেমা সবারই একটা স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু সেখানে কাজ করতে গিয়ে যদি কেউ ন্যূনতম সম্মানটুকু না পায় তাহলে কেউ কেন আগ্রহী হবে সেখানে কাজ করার? অনেক আগে হয়তো যে কেউ চাইলেই সিনেমায় কাজ করতে পারতো; এতকিছু ভাবতে হতো না। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই আপডেট হয়েছে, অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। একজন নতুন হোক কিংবা পুরাতন হোক; ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যেকটা শিল্পী-ই কিন্তু সম্মান ডিজার্ভ করে। এখনকার সময়ে শিক্ষিত মেয়েরা এই কারণেই সিনেমায় আসতে চায় না। কারণ এখানে কাউকে তেমনভাবে ট্রিট করা হয় না। আর এটা এভাবে চলতে থাকলে কোন শিক্ষিত মেয়ে এখানে আসবে না।
এই সিনেমাতে কাজ করতে গিয়ে যতটুক দেখলাম, এখানে শুধু একমাত্র শাকিব খানকেই সবাই প্রাধান্য দেয়, আর কাউকেই না। শাকিব ছাড়া আর কে কি করলো এসব নিয়ে কারোই কোন মাথাব্যাথা নেই।
আমাকে যখন তখন ফোন দিয়ে বলা হতো আজকে তোমার শুট আছে, সকালে চলে এসো। আমি যেহেতু একজন ডাক্তার, আমি সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। আমি সময়মতো সেটে চলে যেতাম। এফডিসিতে হাসপাতালের সেট বানানো হলো। এখন শাকিব খান বলে বসে, হাসপাতালের সব জিনিসপত্র ছাড়া উনি শট দিবেন না। হাসপাতালের ওটির জিনিসপত্র চাইলেই আনা যায়না, সেগুলোর জন্য অনুমতি নিয়ে একটা প্রসেসিংয়ের মধ্যে দিয়ে সেগুলো আনতে হয়। সেগুলোর ব্যবস্থা করতে করতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। আমি সেই সকাল থেকে বসা। আমার শট নেওয়া হচ্ছে না। এভাবে রাত আড়াইটা বেজে যায় তাও আমাকে ডাকে না। তখন পরিচালককে বলে যে শাকিবের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তখন আমি ডিরেক্ট তাকে গিয়ে বলি যে, ভাইয়া আমাকে সকাল থেকে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে রাত ১২টা পর্যন্ত আমার কল টাইম। কিন্তু এখন বাজে রাত আড়ায়টা! আমাকে এভাবে বসিয়ে রাখা হলো কেন? আমার তো সময়ের মূল্য আছে নাকি? আমার মুখে ডিরেক্ট এভাবে কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে যান! তিনি এক্সপেক্ট করেন নি যে আমি এভাবে কথা বলবো। তখন তিনি শুধু জানতে চাইলেন যে আমি কি করি! তখন আমি বললাম যে আমি একজন ডাক্তার! তারপর তিনি আর কিছু বলেন নি। পরে সাথে সাথে আমার অংশটুকু শেষ করে নেওয়ার কথা বলেন।
আরেকটা বিষয় খুব খারাপ লেগেছিলো আমার। আমি যখন একবার ক্যামেরার সামনে শট দিতে দাঁড়ালাম তখন ডিওপি আমাকে বলে যে, এই মেয়ে তুমি এভাবে দাঁড়াও! আমি তখন ডিরেক্ট তাকে বললাম, হয় আমাকে নাম ধরে ডাকেন নয়তো আমার চরিত্রের নামে ডাকেন নয়তো ডাক্তার যেকোন একটা বলে ডাকেন। ‘এই মেয়ে’ কোন সম্বোধন হতে পারে না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই জন্য সম্মানটা খুব জরুরি। কাউকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া উচিত, সে যেই হোক।
কাজটি করতে গিয়ে অমিত হাসান ভাইয়ের অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। তিনি আমাকে না বুঝলে বলে দিয়েছেন। পরিচালকও অনেক সহায়তা করেছেন। কাজ শেষে পরিচালক আমাকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন যে, ‘তুমি অনেক প্রেসিয়াস, এটা ধরে রেখো। একদিন অনেক দূর যাবে তুমি’। তাঁর এই কথাটা আমার অনেক ভালো লেগেছিলো।
প্রথম সিনেমাতে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি এরপর আর কখনও সিনেমা করার নামও মুখে নিবো না। ইচ্ছেটাই মরে গেছে। এখানে কেউ কাউকে সম্মান করে না।